স্বার্থপর
-অঞ্জনা গোড়িয়া
পৃথিবীতে যে কত চরিত্রের যে প্রাণী আছে, তা নিজেরাই জানি না। নিজেদের সুবিধাটুকু ছাড়া আমরা কিছুই বুঝি না। আমিও তেমনই সুবিধাভোগী প্রাণী।সেদিন বিশেষ কাজে বাসে উঠে সল্টলেক যাচ্ছিলাম।
অনেকটা পথ যেতে হবে। বাসে একটাও সিট খালি ছিল না। বেশির ভাগ রাস্তাটা দাঁড়িয়েই থাকতে হল। প্রচন্ড ভীড়। ঠেলাঠেলির মাঝেই শক্ত করে রডটা চেপে ধরলাম। আমার পাশেই এক মধ্যবয়স্ক লোক দাঁড়িয়ে। অল্প বয়সী কিছু মেয়েরাও ছিল পাশেই। যা হয় আর কি। ভিড় গাড়িতে পুরুষের কনুই এর ধাক্কা নয় তো কিছুটা স্পর্শ মেয়েদের অস্বস্তির কারণ।
ভদ্রলোককে বারবার মেয়েগুলি বলল, ছেলেদের দিকে ঘুরে দাঁড়াতে। তবু কিছুতেই গেল না।
যখনই ব্রেক মারে, লোকটি মেয়েগুলির গায়ে ঢলে পড়ে। সিটে বসে থাকা এক মহিলা যা খুশি বলে গালাগালি করল। লজ্জা করে না তোমার। এভাবে ছোট ছোট মেয়েদের ধাক্কা মারছো। বাড়িতে মা বোন নেই। সোজা হয়ে দাঁড়াতে না পারো, বাসে ওঠো কেন?
লোকটার দিকে চোখ পড়তেই মনে হল খুব অসুস্থ।
কেমন চুপ করে মাথা নত করে আছে।
হঠাৎ নিচে বসে পড়ল। ভিড় গাড়িতে এভাবে পড়ে যেতেই হইচই বেঁধে গেল। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েগুলি ভয়ে সরে গেল। কেউ তুলতে এল না। আমার ব্যাগেই জলের বোতল ছিল। অগত্যা চোখে জলের ছিটে দিলাম। চোখটা খুলল। ততক্ষণে দু’টো ছেলে এসে ধরে তুলল। কিন্তু সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতা নেই। জ্বর অবস্থায় এই গরমে বাসে উঠে ছিল। খুব দুর্বল দেখাচ্ছে।
আমি সিটে বসে থাকা সেই মহিলাকে বললাম, একটু সিটটা ছেড়ে দেবেন? উনি খুব অসুস্থ। গজগজ করতে করতে বলল, আপনি হলে ছাড়তেন সিট। যত সব বদমাইসি। খুব যে দরদ দেখছি। নিজের চেনাজানা বুঝি?
এই হল ভদ্রসমাজ। পরের স্টপেজ এ একটা সিট খালি হলে ওনাকে বসতে বললাম। কিছুতেই রাজী হল না।
ভদ্রতার খাতিরে বলল, আমি এখন ঠিক আছি। আপনি বসুন। একটু মাথাটা ঘুরে গিয়ে ছিল।অপমানিত হওয়ার চেয়ে, লেডিস সিটে না বসা’ই ভালো। মহিলা এলেই উঠে যেতে হবে।
সত্যিই তাই। কিছুতেই বসলো না ভদ্রলোক। আমি বসে পড়লাম।
একপাশে রড ধরে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর পুরুষদের দিকে সিট খালি হল।
উনি বসতে গেলেন। পাশেই এক ভদ্রমহিলা বাচ্চা কোলে গাড়িতে উঠল।
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়ালো। বলল, বসুন। বাচ্চা কোলে কষ্ট হবে।
নিঃশব্দে সিটটা ছেড়ে আবার দাঁড়িয়ে পড়ল।
সিটে বসে বাচ্চাটি মায়ের কোলে খিলখিল করে হেসে উঠল। আমি দেখলাম, ভদ্রলোকের মুখে ও তৃপ্তির হাসি।